রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্য (World Literature) জগতে এক অন্যতম নাম। ২৫ শে বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ৭ ই মে, ১৮৬১) কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শতাব্দীর সেরা সাহিত্য প্রতিভা সম্পন্ন এই মানুষটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে নিয়ে ১০ টি অজানা তথ্য
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সপরিবারে পূর্ব বঙ্গ থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতা শহরে। এই শহরের বুকে ব্যবসার পাশাপাশি জমিদারির দায়িত্বও গ্ৰহন করেন তিনি। তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, উচ্চবিত্ত পরিবারের বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্থ হলেও তিনি সমাজসেবা, সমাজসংস্কার এবং আধ্যাত্মিক চর্চায় অত্যাধিক মগ্ন হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ এবং সারদা দেবীর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, গান রচয়িতা, প্রাবন্ধিক এবং সমাজ সংস্কারক।
৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস ও ৩৬ টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন, সর্বমোট ৯৫ টি ছোটগল্প ও ১৯১৫ টি গানের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের ১০ টি অজানা তথ্য আপনাদের জানাবো।
১) আমরা প্রায় অনেকেই জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচটি ছদ্মনাম আছে। যা হল যথাক্রমে ভানুসিংহ, আন্নাকালী পাকড়াশী, অকপটচন্দ্র লস্কর, দিকশূন্য ভট্টাচার্য এবং ষষ্ঠীচরণ দেব শর্মা। কিন্তু এছাড়াও অনেকগুলো ছদ্মনাম তিনি ব্যবহার করতেন যা অনেকের অজানা, তা হল- নবীন কিশোর শর্মণ, বাণীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ, শ্রীমতী কনিষ্ঠা, শ্রীমতী মধ্যমা। ১৯২৪ সালে ৮ মে কবিগুরু তাঁর ৬৩ তম জন্মদিন পালন করেন চিন দেশে। সেইজন্য সেই দেশের সরকার তাঁর নাম দেন ‘চু চেন তাং’।
২) ভারতের ‘জণ গণ মন অধিনায়ক জয় হে’ এবং বাংলাদেশের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীতদ্বয় কবিগুরুর লেখা। এই ঘটনা বিশ্ব সাহিত্যে প্রায় বিরল ঘটনা। কিন্তু মজার বিষয় হল, ভারতের অপর এক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের শিষ্য আনন্দ সিমারানকুল (যিনি শ্রীলঙ্কার নাগরিক) রবিঠাকুরের গীতবিতানের একটি গানের অনুকরণেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত রচনা করেন, যা হল- ‘মাতা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা, সুন্দর শ্রী বরনী।’
৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতি গ্ৰন্থে বলেছেন যে, তিনি তাঁর পিতা মাতার সহচার্য বেশি লাভ করতে পারেননি। বেশিরভাগ সময় ঠাকুরবাড়ির শিশুদের দেখাশোনা করতেন ভৃত্যরা। কিন্তু তাঁর যখন ১১ বছর বয়স তখন তিনি কয়েকমাসের জন্য তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশের হিমালয় পাহাড় ঘেরা ডালহৌসি শহরে থাকাকালীন বাবার কাছে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতেন।
ওই পাহাড়ি শৈলাবাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৩ সালে ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বালে’ নামক তাঁর জীবনের প্রথম গান রচনা করেন। এটি ছিল পাঞ্জাবি একটি ভজনের অনুবাদ। ওই সময় অমৃতসরে এক মাস যখন তিনি বাবার সঙ্গে ছিলেন, তখন বাবা ও ছেলে নিয়মিত যেতেন স্বর্ণমন্দিরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ তে লিখেছেন, সেসময় ওই মন্দিরের ভজন সঙ্গীত তাঁর চিন্তাধারণার উপর বড়ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
৪) জানেন কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের প্রাথমিক পদবী কিন্তু ‘ঠাকুর’ ছিল না। প্রথমদিকে ‘কুশারী’ ছিল উনাদের বংশগত পদবী। পরে কলকাতায় এসে ‘কুশারী’ পদবী বদলে নতুন ‘ঠাকুর’ পদবী গ্ৰহণ করেন রবি ঠাকুরের পূর্ব পুরুষরা।
৫) শুধু সাহিত্য প্রীতিই নয়। খেলাধুলাতেও সমান উৎসাহ ছিল তাঁর। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের, ব্রিটিশ দলকে হারিয়ে শিল্ড জয়ে উচ্ছসিত হয়ে কবি একটা বিশেষ কবিতা রচনা করেন, ‘দে গোল… গোল…’।।
৬) বালক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজগৃহে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি কুস্তিবিদ্যাও শিখতেন। তাঁর কুস্তি শিক্ষকের নাম ছিল হিরা সিং।
৭) সেসময় কবির জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য কবির কাছে সুন্দর সুন্দর লাইনের জন্য প্রার্থনা করতেন। এমনই একটি হল, ‘কাজল কালি’ পণ্যের বিজ্ঞাপনের বিখ্যাত লাইন সমূহ। যেখানে কবি বলেন, ‘ — ব্যবহার করে সন্তোষলাভ করেছি এর কালিমা বিদেশী কালির চেয়ে কোন অংশে কম নয়।’
৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যারিস্টারি পড়তে ১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তিনি আইনজ্ঞ হন। প্রথমে তিনি সমুদ্রতীরের শহর ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এক বছর পরে লন্ডনে আসেন আইনবিদ্যা নিয়ে পড়তে। কিন্তু সাহিত্যচর্চ্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি শেষ করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি শেক্সপিয়র সহ অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে আইনের পড়া শেষ না করেই তিনি ফিরে যান কলকাতায়। তারপর পুরোদমে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজেও পড়াশোনা করেছেন বেশ কিছু দিন।
৯) গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ Song Offerings -এর জন্য ১৯১৩ সালে প্রথম ভারতীয় তথা প্রথম এশীয় বাসী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু জানেন কি তাঁর গীতাঞ্জলির পান্ডুলিপি নোবেল কমিটিকে জমা দিতে যাওয়ার কাহিনী?
কবিভ্রাতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু উইলিয়াম রথেনস্টাইন ১৯১১ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আসেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রথেন্সটাইনের যোগাযোগ বাড়ে, রথেন্সটাইন বার বার কবিকে বিভিন্ন গল্পের , কবিতার ইংরেজি পাণ্ডুলিপি চেয়ে পাঠান এবং বহুবার কবিকে লন্ডনে আসতে অনুরোধ করেন। ১৯১২ সালের মে মাসে রবি ঠাকুর ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য মন স্থির করেন।
১৫ জুন ১৯১২ সালে বিশ্বকবি লন্ডন যাওয়ার উদ্দেশ্যে ডোভার থেকে ট্রেনে চড়েন, সেই অভিযানে সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্র-বধূ প্রতিমা ও বন্ধুসম ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য সৌমেন্দ্রদেব বর্মন।
পরেরদিন কবি খেয়াল করেন গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি যে সুটকেসে নিয়ে এসেছিলেন সেটি নিখোঁজ। বহু খোঁজাখুঁজির পর কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ যখন পুলিশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন তখন রবি ঠাকুর তাঁকে লন্ডন মেট্রোরেলের নিখোঁজ সামগ্রীর অফিসে গিয়ে একবার খোঁজ করার কথা বলেন।
রথীন্দ্রনাথ লন্ডন মেট্রোরেলের অফিসে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে সুটকেসটা খুঁজে পান । যার ভেতরে গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি অক্ষত ছিলো।
১০) জানেন কি নোবেল পুরস্কারে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তিনি কৃষকদের সুবিধার্থে ‘পতিসর কৃষি ব্যাঙ্ক’ নামে একটা ব্যাঙ্ক তৈরি করেন। বাড়ীর পাশাপাশি এলাকার সেতু, সাঁকো মেরামত করেন।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিবিসি নিউজ, প্রথম আলো, বাংলাপিডিয়া।
লিখেছেন সৌমদীপ সেন (Author, ExamBangla.com)